চার দশকে শিবিরের হাতে যত খুন
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪
প্রতিপক্ষ সংগঠনের নেতাকর্মীদের হাত-পায়ের রগ কাটা, হত্যা ও নির্যাতন এবং অস্ত্র ও বোমাবাজির অভিযোগ ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে বরাবরই রয়েছে। ১৯৭৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠিত এ ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠার মাত্র তিন বছর পর থেকেই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শুরু করে, যা চলছে এখনো।
হিসেব করে দেখা গেছে বিগত চার দশকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ক্যাম্পাসেই প্রায় ৩২ জন মেধাবী শিক্ষার্থী শিবিরের বর্বরতার শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। আহত হয়েছে হাজার হাজার শিক্ষার্থী। এছাড়াও তাদের নির্মম খুনের তালিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও রয়েছে।
ঢাকা ইনসাইডারের আজকের পর্বে থাকছে শুধু শিবিরের হাতে হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া শিক্ষার্থীদের বিস্তারিত তথ্য।
১৯৮১ সালে চট্টগ্রাম সিটি কলেজের নির্বাচিত এজিএস ছাত্রলীগ নেতা তবারক হোসেনকে হত্যা করে শিবির। এটি ছিল শিবিরের প্রথম হত্যা। চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্র সংসদ অফিসে বঙ্গবন্ধুর ছবি টাঙানোকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের এক পর্যায়ে শিবির ক্যাডাররা জবাই করে হত্যা করে তবারক হোসেনকে। কিরিচের এলোপাতাড়ি কোপে মুমূর্ষু তবারক যখন পানি পানি করে কাতরাচ্ছিল তখন এক শিবিরকর্মী তার মুখে প্রস্রাব করে দেয়।
১৯৮২ সালের ১১ মার্চ শিবিরের হামলায় মারা যান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ নেতা মীর মোশতাক এলাহী। সেদিন শিবিরের নবীনবরণ নিয়ে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর সাথে সংঘর্ষে আহত হয় আরও প্রায় ৫০ জন।
১৯৮৪ সালে শিবির চট্টগ্রাম কলেজের সোহরাওয়ার্দী হলের ১৫ নম্বর কক্ষে ছাত্র ইউনিয়ন নেতা ও মেধাবী ছাত্র শাহাদাত হোসেনকে জবাই করে হত্যা করে তৎকালীন শিবির ক্যাডাররা। ক্যাম্পাসে সামপ্রদায়িকতা ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে প্রাণ হারাতে হয় তাকে।
১৯৮৮ সালের ৩১ মে রাজশাহীতে শিবির প্রথম নির্মম এবং বর্বর হত্যাকাণ্ডটি ঘটায়। ওইদিন দিনের বেলায় প্রকাশ্যে শিবির ক্যাডাররা রাজশাহী মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্রমৈত্রীর সভাপতি জামিল আকতার রতনকে চার হাত-পায়ের রগ কেটে হত্যা করে।
১৯৮৮ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর সিলেটের রাজনীতির ইতিহাসে কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সৃষ্টি করে ছাত্রশিবির। শিবির ক্যাডাররা ওইদিন প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের নেতা মুনীর-ই-কিবরিয়া চৌধুরী, তপন জ্যোতি ও এনামুল হক জুয়েলকে হত্যা করে।
১৯৯০ সালে হত্যা করা হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রমৈত্রীর সহ সভাপতি ফারুকুজ্জামানকে। দখলদারিত্ব বজায় রাখার জন্য ২২ ডিসেম্বর শান্তিপূর্ণ এক মিছিলে হামলা চালিয়ে হত্যা করা হয় তাকে।
১৯৯২ সালের ১৭ মার্চ পবিত্র রমজান মাসে চট্টগ্রামের কুখ্যাত সিরাজুস সালেহীন বাহিনীসহ কয়েক হাজার সশস্ত্র বহিরাগত শিবীর সন্ত্রাসী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বেলা ১১ টার সময় অতর্কিত হামলা চালালে জাসদ ছাত্রলীগ নেতা ইয়াসীর আরাফাত পিটু নিহত হয়। এ বছর শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিচারের দাবিতে করা আন্দোলনে শিবির হামলা করে। এতে আহত হন জাসদ নেতা মুকিম। পাঁচদিন পর তিনি মারা যান।
১৯৯৩ সালের ১৭ জানুয়ারী রাত এগারোটার দিকে সোহরাওয়ার্দী হল এবং শিবির নিয়ন্ত্রিত জোহা হল এলাকায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় মুহাম্মদ ইয়াহিয়া নামে একজনের মৃত্যু হয়।
১৯৯৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবির সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালালে ছাত্রদল ও সাবেক ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ মিলে গঠিত সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের ওপর শিবিরের হামলায় ছাত্রদল নেতা বিশ্বজিৎ ও নতুন এবং ছাত্র ইউনিয়নের তপন সহ ৫ জন ছাত্র নিহত হয়।
১৯৯৩ সালে ১৯ সেপ্টেম্বর শিবির ক্যাডাররা হামলা চালিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রমৈত্রী নেতা জুবায়ের হোসেন রিমুর হাত-পায়ের রগ কেটে দেয়। এতেই সন্তুষ্ট হয়নি ঘাতকেরা। মেঝেতে পড়ে থাকা রিমুকে কুপিয়ে কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
১৯৯৪ সালের ২৭ অক্টোবর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক নুরুল হুদা মুসা কে ছাত্রশিবিরের ক্যাডাররা হাত ও পায়ের রগ কেটে দিলে ১০ দিন পর ৬ নভেম্বর ১৯৯৪ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন মুসা।
১৯৯৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি শিবিরের হাতে খুন হন ছাত্রমৈত্রীর আরেক নেতা দেবাশীষ ভট্টাচার্য। শিবির কমীরা বিশ্ববিদ্যালয় পার্শ্ববর্তী চৌদ্দপাই নামক স্থানে রাজশাহী থেকে ঢাকাগামী সকাল-সন্ধ্যা বাসে হামলা চালিয়ে তাকে বাসের মধ্যে যাত্রীদের সামনে কুপিয়ে হত্যা করে। হত্যার আগে বর্বর শিবির ক্যাডাররা তার হাত ও পায়ের রগ কেটে নেয়।
১৯৯৭ সালে শিবিরের হামলার শিকার হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ কর্মী বকুল। বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী এলাকায় এক কটেজে ঘুমন্ত অবস্থায় তাকে কুপিয়ে হত্যা করে শিবির ক্যাডাররা।
১৯৯৮ সালে বরিশাল থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসা ছাত্র আইয়ুব আলী শিবিরের হাতে নিহত হন। ১৮ মে চট্রগ্রাম শহরতলির বটতলী এলাকায় শহরগামী শিক্ষকবাসে শিবিরের গুলিবর্ষণের ঘটনায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মুসফিকুর সালেহীন নিহত হন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী সঞ্জয়কে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় একই বছর।
১৯৯৮ সালের ২৪ মে সিলেটের ব্লু-বার্ড স্কুলের সামনে ছাত্রলীগ নেতা সৌমিত্র বিশ্বাসকে হত্যা করা হয়। সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের ছাত্র ছিলেন।
২০০০ সালের ১২ জুলাই বহুল আলোচিত ৮ মার্ডারের ঘটনা ঘটে চট্টগ্রামে। এ বছর চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে ৬ জন ছাত্রলীগ নেতাকর্মী ও ২ জন ড্রাইভারকে প্রকাশ্য দিবালোকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে শিবির ক্যাডাররা।
২০০১ সালের ২৯ ডিসেম্বর শিবিরের হাতে নিহত হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতা আলী মর্তুজা। সেলুনে বসা অবস্থায় শিবির ক্যাডাররা তাকে এলোপাথাড়ি গুলে করে চলে যায়।
২০০২ সালের ৯ সেপ্টেম্বর শিবিরের সন্ত্রাসীরা খুন করে মদন মোহন কলেজের ছাত্রদল নেতা হামিদ খান দোয়েলকে। দোয়েলের হত্যার ধরণ ছিলো খুবই ভয়াবহ,বর্বর। তার শরীর থেকে ঘাতকেরা তার একটি হাত বিচ্ছিন্ন করে ফেলে, এমনকি তার গোপনাঙ্গ পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন করা হয়।
২০০৪ সালের ৩১ আগস্ট শিবির ক্যাডাররা খুন করে সিলেট ভেটেরিনারি কলেজ (বর্তমান সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়)-এর ছাত্রদল নেতা রফিকুল হাসান সোহাগকে।
২০১০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলসহ বেশ কয়েকটি হলে সশস্ত্র হামলা চালায় শিবিরের নেতা-কর্মীরা। সেই হামলায় শাহ মখদুম হলের ছাত্রলীগ নেতা ফারুককে মেরে হলের পিছনে ম্যানহোলে ফেলে রাখে শিবির।
একই বছর ১২ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র এ এম মহিউদ্দিনকে শিবির ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে।
২০১৩ সালের নভেম্বরে শিবির সর্বশেষ হত্যাকাণ্ডটি ঘটায়। শিবির ক্যাডাররা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের শাহ মখদুম হল শাখার সভাপতি আব্দুল্লাহ আল মামুনকে তার গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে গিয়ে খুন করে আসে।
পরের পর্বে থাকবে শিবিরের অন্যান্য হত্যাকাণ্ডের আদ্যোপান্ত